-->

Breaking

শুক্রবার, ৩০ মে, ২০২৫

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বছর ও ঘটনা - freedom fight

 ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বছর ও ঘটনা

১. ১৭৫৭ – পলাশির যুদ্ধ: ভারতের ভাগ্য নির্ধারক সূচনা

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এই যুদ্ধ শুধু একটি আঞ্চলিক সংঘর্ষ নয়, এটি ছিল ভারতের উপনিবেশিক দাসত্বের সূচনা বিন্দু। এই যুদ্ধে মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা, ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র, এবং কোম্পানির লোভী নীতি স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়।



২. ১৮৫৭ – সিপাহী বিদ্রোহ: ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে ধরা হয়। মঙ্গল পাণ্ডে-র নাম এই বিদ্রোহের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই বিদ্রোহ শুধু একটি সামরিক বিদ্রোহ ছিল না, বরং সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে এক অভ্যন্তরীণ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। দিল্লি, কানপুর, লক্ষ্ণৌ, ঝাঁসি, ও গ্বালিয়রের রাজা-রানিরা একত্রিত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েছিলেন। রানি লক্ষ্মীবাইয়ের বীরত্ব ও তাত্যাঁ টোপের নেতৃত্ব আজও অনুপ্রেরণা জোগায়।


৩. ১৮৮৫ – ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা

১৮৮৫ সালে হিউম সাহেবের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় Indian National Congress। শুরুতে এটি ছিল ইংরেজ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার মঞ্চ, কিন্তু ধীরে ধীরে এটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে পরিণত হয়। দাদাভাই নওরোজি, বাল গঙ্গাধর তিলক, গোখলে প্রমুখ নেতারা কংগ্রেসকে গণমানুষের দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হন।


৪. ১৯০৫ – বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলন

লর্ড কার্জনের নেতৃত্বে ১৯০৫ সালে বাংলা বিভাজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় স্বদেশি আন্দোলন, যার মূল স্লোগান ছিল – "বয়কট করো বিদেশি পণ্য, গ্রহণ করো স্বদেশি দ্রব্য"। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাঙালির আত্মার জাগরণ’ ঘটানোর জন্য রাখী বন্ধন উৎসবের আয়োজন করেন। অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন চন্দ্র পাল, লালা লাজপত রায়, ও বলগঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে এই আন্দোলন জনজাগরণে রূপ নেয়।


৫. ১৯১৯ – জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যা কাণ্ড ও রাওলাট আইন

১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন পাশ করে, যা ইংরেজ সরকারকে বিনা বিচারে ভারতীয়দের আটক রাখার অধিকার দেয়। এই আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের অমৃতসরে সভা করার সময় ১৩ এপ্রিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার অজস্র নিরস্ত্র ভারতীয়দের উপর গুলি চালায়। এই বর্বরতা সারা দেশের হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাইটহুড ত্যাগ করেন।




৬. ১৯২০ – অসহযোগ আন্দোলন

মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। লক্ষ্য ছিল – বিদেশি কাপড়, স্কুল, আদালত বর্জন করে দেশীয় উদ্যোগকে শক্তিশালী করা। এটি ছিল অহিংস পথে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বৃহত্তর প্রতিবাদ। চরখা, খাদি, ও আত্মনির্ভরতার বার্তা তখন ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়।


৭. ১৯৩০ – লবণ সত্যাগ্রহ ও দাণ্ডি অভিযান

১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধী ২৪ দিন ধরে ২৪০ মাইল হেঁটে দাণ্ডি পৌঁছান ও সেখান থেকে লবণ আইন ভাঙেন। এই প্রতীকী প্রতিরোধ সারা দেশে আন্দোলনের ঢেউ তোলে। লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেন। এই ঘটনার মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে শুরু করে।


৮. ১৯৪২ – ভারত ছাড়ো আন্দোলন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশরা ভারতের সম্পদ ব্যবহার করলেও ভারতকে স্বাধীনতার কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এর প্রতিবাদে ১৯৪২ সালে কংগ্রেস “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনের ডাক দেয় – “করো বা মরো”। ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের বন্দি করে রাখে, কিন্তু জনগণের আন্দোলন থামানো যায়নি। বোম্বে, কলকাতা, বিহার, উত্তরপ্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যে যুব সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল অবিস্মরণীয়।


৯. ১৯৪৬ – নৌ-বিদ্রোহ ও ক্যাবিনেট মিশন

১৯৪৬ সালে মুম্বইয়ের নৌ-বিদ্রোহ ব্রিটিশদের স্তম্ভিত করে। প্রায় ২০ হাজার নৌ-সেনা বিদ্রোহ করে ব্রিটিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি, ব্রিটিশ সরকার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে আলোচনার জন্য “ক্যাবিনেট মিশন” পাঠায়। এই সময়ই কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে মতানৈক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং দেশভাগের ছায়া ঘনিয়ে আসে।

১০. ১৯৪৭ – স্বাধীনতা ও দেশভাগ

১৫ আগস্ট ১৯৪৭ – বহু ত্যাগ, রক্ত, ও সংগ্রামের বিনিময়ে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। তবে সেই স্বাধীনতা ছিল বিষাদময়, কারণ ভারত ও পাকিস্তানের দেশভাগ হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হন, সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে পাঞ্জাব ও বাংলা জুড়ে। গান্ধিজি এই সময় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ান, কিন্তু শেষপর্যন্ত ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, নাথুরাম গডসের হাতে তিনি নিহত হন।




উপসংহার

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধুমাত্র রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি একটি জাতির আত্ম-অন্বেষণ, আত্মত্যাগ ও আত্মনির্ভরতার গল্প। প্রত্যেকটি বছর, প্রতিটি ঘটনা ভারতের বুকে এক একটি চিরন্তন চিহ্ন রেখে গেছে। আজ আমরা যে স্বাধীনতা উপভোগ করছি, তা লক্ষ লক্ষ নাম না-জানা শহিদের রক্তে রঞ্জিত। তাদের ত্যাগ ও সংগ্রাম আমাদের জাতীয় চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে এবং আমাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয় – এই স্বাধীনতা রক্ষা করা, ও সঠিক পথে দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন