-->

Breaking

বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০২৫

পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য

পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য: এক নজরে মজাদার কিন্তু তথ্যপূর্ণ আলোচনা

প্রারম্ভিকা:

'পশ্চিমে গঙ্গা, উত্তরে পাহাড়, দক্ষিণে সমুদ্র আর মাঝখানে মাটির টান – এই তো আমাদের প্রিয় পশ্চিমবঙ্গ।' শুধু বাংলা কবিতার পঙ্‌ক্তি নয়, এ কথাগুলোই পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক পরিচিতির সারাংশ। এই লেখায় আমরা জানব কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের ভূগোল আমাদের জীবন, সংস্কৃতি, কৃষি, আবহাওয়া এবং অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলে। চলুন তবে, মজাদার ভাষায় একবারে বিশ্লেষণ করে ফেলি আমাদের রাজ্যকে!

১. অবস্থান ও বিস্তার:

পশ্চিমবঙ্গ ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি রাজ্য, যার ভৌগোলিক অবস্থান ২১°৩৮' উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৭°১০' উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৫°৫০' পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৮৯°৫০' পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৬২৫ কিমি এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৩২৫ কিমি বিস্তৃত এই রাজ্যটি প্রায় ৮৮,৭৫২ বর্গকিমি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।



২. সীমা ও প্রতিবেশী রাজ্য:

পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে রয়েছে সিকিম ও ভুটান, পশ্চিমে বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে বাংলাদেশ।

এক কথায় বললে – পশ্চিমবঙ্গ এমন এক রাজ্য যেটি পাহাড়, সমুদ্র, নদী ও সমতল – সবকিছুই একসাথে ধারণ করেছে।


৩. ভৌমরূপ / ভূপ্রকৃতি:




পশ্চিমবঙ্গের ভূপ্রকৃতি মোটামুটি পাঁচটি প্রধান অঞ্চলে ভাগ করা যায়:

(ক) উত্তর-পাহাড়ি অঞ্চল:

এই অঞ্চলে রয়েছে হিমালয়ের অংশ – দার্জিলিং হিমালয়। এখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু শিলিগুড়ি, কালিম্পং, কার্শিয়াং, দার্জিলিং এর মত মনোরম স্থানগুলি রয়েছে। এই অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণ, ভূমিধ্বস সাধারণ ঘটনা।


(খ) তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চল:

হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই অঞ্চল নদীবিধৌত ও উর্বর। উত্তরবঙ্গের চা চাষ এখানেই কেন্দ্রীভূত।


(গ) রাঢ় অঞ্চল:

ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন পশ্চিমাংশে অবস্থিত এই অঞ্চল হল প্রাচীন গন্ডোয়ানা ভূমির অংশ। লালমাটি, অম্লধর্মী মাটি এবং কাঁকুরে জমি এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য।


(ঘ) গঙ্গা-নদীবিধৌত সমভূমি:

রাজ্যের বৃহত্তম অংশ জুড়ে রয়েছে এই সমভূমি, যা উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে দক্ষিণবঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত। কৃষি, জনঘনত্ব এবং নগরায়নের মূল কেন্দ্র এখানেই।


(ঙ) নিম্ন জলাভূমি ও বদ্বীপ অঞ্চল:

সুন্দরবনের মত গাঙ্গেয় বদ্বীপ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার নদীবিধৌত অঞ্চল এই শ্রেণীতে পড়ে। ম্যানগ্রোভ বন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং চিংড়ি চাষ এই অঞ্চলের সম্পদ।


৪. নদনদী ও জলব্যবস্থা:

'গঙ্গা-মা’র কোলে বেড়ে ওঠা এই বঙ্গভূমি যেন নদীমাতৃক এক কবিতা।'

 গঙ্গা – রাজ্যের প্রধান নদী। এটি ভাগ হয়ে হুগলি নদীতে পরিণত হয়, যা কলকাতার পাশ দিয়ে প্রবাহিত।

 তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, মহানন্দা – উত্তরবঙ্গের নদী।

 দ্বারকেশ্বর, দামোদর, রূপনারায়ণ, অজয় – পশ্চিমবঙ্গের মধ্যাঞ্চলের নদী। দামোদর একসময় 'বাংলার শোক' নামে পরিচিত ছিল বন্যার জন্য।

নদীগুলি কৃষি, পানীয় জল, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৫. জলবায়ু:

পশ্চিমবঙ্গ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মৌসুমি জলবায়ুর অন্তর্ভুক্ত। চারটি ঋতু প্রধান:

 গ্রীষ্ম (মার্চ-জুন)

 বর্ষা (জুন-সেপ্টেম্বর)

 শরৎ ও হেমন্ত (অক্টোবর-নভেম্বর)

 শীত (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি)

উত্তরবঙ্গ শীতল ও আর্দ্র, দক্ষিণে গ্রীষ্মকাল বেশ গরম ও আর্দ্র। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর উপর নির্ভরশীল।

৬. মাটি ও উদ্ভিদ:

মাটির ধরন অঞ্চলে অঞ্চলে ভিন্ন। যেমন:

 আলুভিয়াল মাটি – গঙ্গা উপত্যকা (খুব উর্বর)

 লাল ও ল্যাটেরাইট মাটি – রাঢ় ও পুরুলিয়া অঞ্চলে

 পাহাড়ি মাটি – দার্জিলিং অঞ্চলে

উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে:-

 শাল, সেগুন, বেল, অশ্বত্থ, নিম – বনাঞ্চলে

 ম্যানগ্রোভ – সুন্দরবনে

 বাঁশ ও বেত – ডুয়ার্সে

৭. প্রাণীকুল:

 রয়েল বেঙ্গল টাইগার – সুন্দরবনের গর্ব

 হাতি ও গৌর – উত্তরবঙ্গের বনে

 চিতা, হরিণ, বন বিড়াল – বিভিন্ন বনাঞ্চলে

 বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ এবং জলজ প্রাণী – যেমন গঙ্গার ডলফিন

৮. খনিজ সম্পদ:

যদিও পশ্চিমবঙ্গ খনিজে অতটা সমৃদ্ধ নয়, তবুও পুরুলিয়া ও বীরভূম অঞ্চলে কয়লা, তামা, এবং সিলিমিনাইট পাওয়া যায়। এছাড়া ঝাড়গ্রাম অঞ্চলে কিছু লোহা আকর পাওয়া যায়।


৯. কৃষি ও ভূগোলের সম্পর্ক:


পশ্চিমবঙ্গের ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু কৃষির জন্য খুবই উপযোগী। ধান, পাট, আলু, গম, চা, আখ – সব ধরনের ফসল চাষ এখানে হয়। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চলে চা চাষ বিখ্যাত। গঙ্গা উপত্যকার উর্বর মাটিতে বছরে তিনবার ফসল ফলে।


১০. পরিবহন ও নদী-ভূগোল:


পশ্চিমবঙ্গের সমতল ভূমি ও নদীবহুল অঞ্চল রেল ও সড়কপথ নির্মাণে সাহায্য করেছে। হুগলি নদী বরাবর নদীবন্দর যেমন কলকাতা ও হলদিয়া গড়ে উঠেছে।


১১. ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও মানুষের জীবনযাত্রা:

 পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষের জীবন প্রকৃতি নির্ভর ও পর্যটনকেন্দ্রিক

 সমতলে কৃষিনির্ভর জীবন

 নদীবিধৌত অঞ্চলে মাছ চাষ ও নৌপরিবহণ

 বদ্বীপ অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বন রক্ষা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা

১২. ভৌগোলিক সমস্যাবলি:




 বন্যা (বিশেষত দামোদর ও গঙ্গা উপত্যকায়)

 ভূমিধ্বস (দার্জিলিং অঞ্চলে)

 নদীভাঙন (মালদা ও মুর্শিদাবাদে)

 লবণাক্ততা বৃদ্ধি (সুন্দরবনে)

উপসংহার:

পশ্চিমবঙ্গের ভূগোল যেন একটি বৈচিত্র্যময় ক্যানভাস – যেখানে পাহাড়, নদী, সমুদ্র, বন, সমভূমি – সব একসাথে মিলেমিশে মানুষের জীবনযাত্রা গড়ে তুলেছে। সরকারী পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকাটা যেমন আবশ্যিক, তেমনই এই জ্ঞান আমাদের স্থানীয় পরিচয়কেও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।

আপনি যদি কখনও পশ্চিমবঙ্গকে একটি লাইভ ম্যাপ হিসেবে ভাবেন, তাহলে এই ভূগোলই তার রূপরেখা – আর প্রতিটি মানুষ যেন তার চলমান অংশ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন