ভারতের ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য
ভূমিকা
ভারত, বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ এবং দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল রাষ্ট্র, তার বিস্তৃত ভৌগলিক বৈচিত্র্য এবং পরিবেশগত বিভিন্নতার জন্য পরিচিত। উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত, পশ্চিমে থার মরুভূমি থেকে পূর্বের পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চলে, ভারত এক অনন্য ভৌগোলিক চিত্র উপস্থাপন করে। এই ভূখণ্ডে রয়েছে পর্বত, সমভূমি, মালভূমি, মরুভূমি, উপকূলীয় অঞ্চল এবং দ্বীপপুঞ্জ, যার ফলে ভারতের জলবায়ু, প্রাণীজগৎ ও মানবজীবনের মধ্যে গঠনমূলক বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়।
ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান
ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এটি ৮°৪’ উত্তর অক্ষাংশ থেকে ৩৭°৬’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৬৮°৭’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৯৭°২৫’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। এর দক্ষিণে বিস্তৃত ভারত মহাসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর এবং পূর্বে বঙ্গোপসাগর। ভারতের উত্তর ভাগে রয়েছে বিশাল হিমালয় পর্বতমালা, যা এক প্রাকৃতিক প্রাচীর হিসেবে কাজ করে।
আয়তন ও বিস্তৃতি
ভারতের মোট আয়তন ৩২,৮৭,২৬৩ বর্গ কিমি, যা পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ হিসেবে বিবেচিত। উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত প্রায় ৩২১৪ কিমি এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত প্রায় ২৯৩৩ কিমি বিস্তৃত। ভারতের স্থলসীমান্ত প্রায় ১৫,২০০ কিমি এবং উপকূলরেখা প্রায় ৭,৫১৬ কিমি।
প্রতিবেশী দেশসমূহ
ভারতের সীমান্ত ৯টি দেশের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি দেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে—চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার এবং আফগানিস্তান (পাক-অধিকৃত কাশ্মীর অংশে)। শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ সমুদ্রের দ্বারা বিভক্ত প্রতিবেশী দেশ।
ভারতের প্রধান ভৌগোলিক অঞ্চলসমূহ
ভারতের ভূপ্রকৃতি সাধারণত ছয়টি প্রধান অঞ্চলে ভাগ করা যায়:
১. হিমালয় পর্বতমালা
ভারতের উত্তর সীমানায় অবস্থিত হিমালয় পর্বতমালা পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্খলা। এটি তিনটি ভাগে বিভক্ত—হিমাদ্রি (মধ্য হিমালয়), হিমাচল এবং শিবালিক। হিমালয় শুধু প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা দেয় না, বরং ভারতীয় নদনদীর উৎসস্থল হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২. উত্তর ভারতের সমভূমি
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং ইন্দাস নদীর দ্বারা গঠিত এই সমভূমি ভারতের সবচেয়ে উর্বর অঞ্চল। কৃষি, জনসংখ্যা ঘনত্ব এবং শহরায়নের দিক থেকে এটি ভারতের প্রাণকেন্দ্র।
৩. ভারতীয় মালভূমি অঞ্চল
দাক্ষিণাত্য মালভূমি বা পেনিনসুলার মালভূমি ভারতীয় ভূপ্রকৃতির একটি প্রাচীন অংশ। এটি দুই ভাগে বিভক্ত—ছোটনাগপুর মালভূমি ও দাক্ষিণাত্য মালভূমি। এখানকার খনিজ সম্পদ প্রাচুর্যপূর্ণ।
৪. পশ্চিম ভারতের মরুভূমি
রাজস্থানের থার মরুভূমি একটি শুষ্ক অঞ্চল যা বার্ষিক অল্প বৃষ্টিপাত পায়। এখানকার জীবনযাত্রা অনেকটাই প্রতিকূলতা পূর্ণ হলেও ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ।
৫. উপকূলীয় সমভূমি
ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলে দুইটি প্রধান সমভূমি অঞ্চল রয়েছে—করমণ্ডল উপকূল ও মালাবার উপকূল। এই অঞ্চলগুলো বন্দর, মাছ ধরার শিল্প এবং পর্যটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৬. দ্বীপপুঞ্জ
ভারতের দুটি প্রধান দ্বীপপুঞ্জ হলো অন্ধমান ও নিকোবর (বঙ্গোপসাগরে) এবং লক্ষদ্বীপ (আরব সাগরে)। এগুলোর পরিবেশগত ও সামরিক গুরুত্ব রয়েছে।
নদনদী ব্যবস্থা
ভারতের প্রধান নদীগুলি দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত:
হিমালয়নদী:
এই নদীগুলি হিমবাহ থেকে উৎপন্ন। যেমন: গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ইন্দাস। এরা বারোমাস জলপ্রবাহ বজায় রাখে।
উপদ্বীপীয় নদী:
এই নদীগুলি বর্ষা নির্ভর। যেমন: গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী, মহানদী। এদের জলপ্রবাহ মৌসুমি বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে।
জলবায়ু
ভারতের জলবায়ু মূলত মৌসুমি (Monsoon)। এখানে প্রধানত চারটি ঋতু দেখা যায়:
শীতকাল (ডিসেম্বর–ফেব্রুয়ারি)
গ্রীষ্মকাল (মার্চ–মে)
বর্ষাকাল (জুন–সেপ্টেম্বর)
শরৎকাল (অক্টোবর–নভেম্বর)
ভারতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বর্ষাকালে ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে, যা কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য।
মৃত্তিকা
ভারতে বিভিন্ন ধরণের মৃত্তিকা পাওয়া যায়:--
অলুভিয়াল মৃত্তিকা (গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায়)
কৃষ্ণ মৃত্তিকা বা ব্ল্যাক সয়েল (দাক্ষিণাত্য মালভূমিতে)ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা (উচ্চভূমি অঞ্চলে)
বালুকাময় মৃত্তিকা (মরুভূমিতে)
বন ও প্রাণীজ সম্পদ
ভারতের বনাঞ্চল ২০% এরও বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে উষ্ণমণ্ডলীয় চিরহরিৎ বন, পতনশীল বন, শুষ্ক বন ও পাহাড়ি বন অন্তর্ভুক্ত। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হাতি, গণ্ডার, সিংহ, চিতাবাঘ, হিমালয়ান ভালুক ইত্যাদি প্রাণী এ দেশের মূল বন্যপ্রাণী।
খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ
ভারত লৌহ, কয়লা, বক্সাইট, তামা, সোনা, চুনাপাথর, প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলসহ বিভিন্ন খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। ছোটনাগপুর মালভূমি ও দাক্ষিণাত্য অঞ্চল খনিজের জন্য বিখ্যাত।
ভারতের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের গুরুত্ব
এই বৈচিত্র্য ভারতের কৃষি, অর্থনীতি, পর্যটন, জনজীবন এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হিমালয় প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা দেয়, সমভূমি কৃষির প্রাণ, নদীজল বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচের উৎস, বন ও খনিজ দেশের সমৃদ্ধির রসদ।
উপসংহার
ভারতের ভূগোল শুধু তার ভূমিরূপ বা জলবায়ুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি ভারতীয় সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিভিন্ন ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য একত্রে ভারতের জাতীয় ঐক্য ও বৈচিত্র্যের অনন্য প্রতিচ্ছবি গড়ে তুলেছে। তাই ভারতের ভূগোল বুঝতে পারা মানেই ভারতের প্রাণ বুঝতে পারা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন